আমার কোনও দেশ নেই, ভাষাই আমার দেশ

তসলিমা নাসরিন: ১. পৃথিবীতে ভাষা আছে প্রায় সাত হাজারের মতো। অর্ধেকই মরে যাবে।

প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষার মৃত্যু হচ্ছে, বাংলা ভাষারও মৃত্যু হবে। ভাষাকে গায়ের জোরে টিকিয়ে রাখা যায় না। ভাষাকে ভালোবাসা দিয়ে টিকিয়ে রাখা যায়। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসার জন্য খুব বেশি বাঙালি অবশিষ্ট নেই। যে বাঙালির বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষা জানা নেই, সেই বাঙালিই বাধ্য হয়ে বাংলা ভাষাটি বলে। একে বিকৃত করার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই চলছে। অনেক বাঙালি বাধ্য হয়ে বাংলা বলে। ইংরেজি ভালো জানলে ইংরেজিটাই বলতো, হিন্দিটা, উর্দুটা, আরবিটা ভালো জানা থাকলে ওগুলোই বলতো, বাংলা বলতো না। প্রচুর বাঙালিকে আমি দেখেছি ইংরেজি কম জেনেও সাহেব সাজার জন্য ইংরেজি বলে। আরবি কম জেনেও ইসলাম-বিশেষজ্ঞ সাজার জন্য আরবি বলে। বাংলাকে ভালো আসলে কজন বাসে? ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শহরের ছেলেমেয়েরা পারতপক্ষে বাংলা বলতে চায় না। এরাই যদি দেশের ভবিষ্যৎ, তবে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ ঠিক কী, তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি।

 

ভাষার বিবর্তন প্রতিনিয়ত হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত উপন্যাসের ভাষার সঙ্গে ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত প্যারিচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালের ভাষার বিস্তর পার্থক্য। বিবর্তিত হয়ে বাংলা শেষ অবধি কোথায় পৌঁছোবে, জানি না। তবে বাংলা ভাষায় নানা ভাষা থেকে শব্দ এসেছে, কিছু শব্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসেছে, কিছু শব্দকে আনা হয়েছে জোর করে। জোর করে শব্দ ধরে আনলে পুলক জোটে হয়তো, আপাতত ভাষাকেও কিঞ্চিৎ মাংসল করা যায়, কিন্তু আখেরে ভাষার লাভ কী দাঁড়ায় সেটাই দেখার বিষয়। ভাষা ক্রমশ হাড্ডিসার হচ্ছে, ভাষার গায়ে রকমারি অলংকার চড়ানো হচ্ছে। বাংলার বৈজ্ঞানিক পরিভাষার হাল দেখলে চোখে জল আসে। প্রতিশব্দ কি রচিত হচ্ছে যতটা রচিত হওয়া উচিত? একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছেন বৈজ্ঞানিক পরিভাষা। অভিযোজন (Adaptation), প্রজননতত্ত্ব, আঙ্গিক (Technique) এসব রবীন্দ্রনাথের তৈরি শব্দ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ শিক্ষার জন্য পারিভাষিকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু পারিভাষিক চর্ব্য জাতের জিনিস। দাঁত ওঠার পরে সেটা পথ্য। সেই কথা মনে করে যতদূর পারি পরিভাষা এড়িয়ে সহজ ভাষার দিকে মন দিয়েছি।’ সহজ ভাষায় লিখতে গিয়ে অনেক সহজ পরিভাষা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, যেমন লাল উজানি আলো (infrared light), বেগনি পারের আলো (ultra violet light), গ্রহিকা (asteroid), আঙ্গারিক গ্যাস (কার্বন ডাইঅক্সাইড)। তাঁর তৈরি প্রতিশব্দ প্রচলিত হয়নি। অনেক বিদেশি বৈজ্ঞানিক শব্দকে রবীন্দ্রনাথ সে কালেই বাংলায় গ্রহণ করেছেন, যেমন হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, প্রোটন, নিউট্রন, পজিটিভ, নেগেটিভ। আজকাল টেকনোলজি সম্পর্কিত ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কোনও কবি বা সাহিত্যিক তৈরি করার চেষ্টা করেন বলে মনে হয় না। প্রতিশব্দ তৈরি হলেও আমার মনে হয় না আদৌ কেউ ব্যবহার করতে চাইবে সেসব। শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলছেন দাদি নানিরা, মা মাসিরা। হাইটেক জীবন তাদের না হলেও চলে। হাইটেক জীবন যাদের, তারা একটি বাংলা বাক্য বললে বাক্যের ১০টির মধ্যে পাঁচটি শব্দই থাকে ইংরেজি। তারা পরিভাষা পছন্দ করে না।

 

বাংলা ভাষা সম্পর্কে এক লেখক খুব সুন্দর বলেছেন, “বাংলাকে আমরা কিন্তু শুধু অন্দরমহলের ভাষা করেই রাখলাম এ যাবৎ। কর্মজগতের ভাষা বা গুরুতর চর্চার ভাষা হিসেবে বাংলাকে বেছে নেওয়ার চেষ্টাই করলাম না সেভাবে। একটু ঘরোয়া কথকতা, একটু রোয়াকি আড্ডা, একটু ভালোবাসা, একটু বিতণ্ডা, একটু খুনসুটি, একটু রং-তামাশা এর বাইরে সেভাবে কোনও ভূমিকাই নিতে দিলাম না বাংলা ভাষাকে। বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে, গল্পে-গানে-বিনোদনেও বাংলাকে আমরা রেখেছি ঠিকই। কিন্তু এইটুকু ব্যবহারিক পরিসর ভাষার কাক্সিক্ষত বিকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। সে বিকাশের জন্য জীবনের গূঢ়তর এবং গুরুতর ক্ষেত্রগুলোতেও বাংলার ব্যবহার সুনিশ্চিত করা জরুরি ছিল। সে চেষ্টা আমরা করলাম না। বাংলাকে আমরা খিডকি-পুকুর বানিয়ে রাখলাম, যেখানে শুধু বাসন মাজি। বাংলাকে সেই মহাসমুদ্র হয়ে উঠতে দিলাম না, যে জলভাগে বাণিজ্য তরী ভাসিয়ে আমি বিশ্বজয় করতে পারি। বাণিজ্যের জন্য আমরা বেছে নিলাম ধার করা জলভাগকে।

 

ভাষা ক্রমবিবর্তনশীল, ভাষা ক্রমবিকাশশীল। সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, কোনও ভাষাই আজ পর্যন্ত সর্বাঙ্গীণ পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। আদান-প্রদানের ঘাত-প্রতিঘাতেই ভাষার বিকাশ হয়, ভাষার শব্দকোষ বাড়ে, ভাষা বলিষ্ঠ হয়, ভাষা প্রসার পায়। কিন্তু বাংলাকে অন্দরমহলে কুক্ষিগত করে রেখে সেই ঘাত-প্রতিঘাতটা থেকেই বঞ্চিত করলাম আমরা।’’

 

দরিদ্রের ভাষার এই-ই হাল হয়। রাজনীতিতে, শিক্ষায়, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, বাণিজ্যে বাংলা পিছিয়ে আছে বলে বাংলা ভাষার কোনও মূল্য নেই বাইরের দুনিয়ায়। একসময় মানুষ ইংরেজি ফরাসি শিখেছে ওই ভাষা ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষা ছিল বলে। পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, ওলন্দাজ ভাষা বাণিজ্যের কারণে শিখতো। দুর্বলের এবং দরিদ্রের ভাষা কেউ শিখতে চায় না। বাংলা শিখে চাকরি পাওয়া যায় না বলে বাঙালিরা বাংলা শেখে না, সেখানে বিদেশিরা কেন শিখবে বাংলা। এশিয়ার যে ভাষা শিখতে মানুষ আগ্রহ প্রকাশ করে, তা জাপানি অথবা চৈনিক।

 

আক্ষেপ করা মানে সময় নষ্ট করা। আর সব কিছুর মতো করে বাংলা ভাষাও নিজের মতো বেঁচে থাকবে। ভালোবেসে এটিকে উচ্চারণ যত করবো, ভাষা তত বেঁচে থাকবে। একে যত দূরে সরাবো, তত দূরে সরবে। সত্যি কথা বলতে কী, বাংলা ভাষাটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে বিদেশিদের বাংলা ভাষা জানার দরকার নেই, বাঙালিকেই বাংলাটা জানতে হবে। তাহলেই টিকে থাকবে। ভালোবাসলে আর সবকিছু যেমন টিকে থাকে, ভাষাও তেমনি টিকে থাকে। আর তা না হলে পরিণতি তো আমরা জানিই, মৃত্যু। মরলেও সহজে মরছে না, দীর্ঘ সময় নেবে। পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা বাংলা। একুশ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। একুশ কোটি মানুষের মুখের ভাষা খুব শিগগির কেড়ে নেওয়ার মতো বড় স্বৈরাচার এখনও তৈরি হয়নি কোথাও। তবে এটা ঠিক, পৃথিবীতে এই বাঙালিই তার ভাষাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে, আবার এই বাঙালিই তার ভাষাকে প্রাণপণে ঘৃণা করে। বাঙালিই এই ভাষাকে বাঁচিয়েছে, বাঙালিই এই ভাষাকে মারবে। বাইরের কোনও বহিরাগত আততায়ীর দরকার হবে না এ কাজে।

 

২. বাঙালি কি ভালোবাসে নিজের ভাষাকে? আমার অভিজ্ঞতা বলে, অধিকাংশ বাঙালিরই বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে কোনও গৌরব নেই। পূর্ব বাংলায় দেখি বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতির ওপর ধর্মের নামে আরবি ভাষা এবং আরবি সংস্কৃতি চাপানোর উৎসব, পশ্চিমবঙ্গে সর্বভারতীয় হওয়ার নামে বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতির ওপর হিন্দি ভাষা এবং হিন্দি সংস্কৃতি চাপানোর উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের গরিব-বাঙালি হিন্দি ভাষা বলে জাতে ওঠেন, ধনী-বাঙালি ইংরেজি ভাষা বলে জাতে ওঠেন। বাংলা ভাষা আমার মতো বোকাসোকা বাংলা ভাষার লেখক কাম পাঠক মধ্যবিত্তরাই আবেগ, ভাষাকে ভালোবেসে যে মানুষ ইউরোপ আমেরিকা ছেড়ে এসেছে। এসে হতবুদ্ধি হয়ে যা দেখছি, তা হলো, কোনও মূর্খ অশিক্ষিত লোক ইংরেজি ভাষা ভালো বলতে পারলেই তাঁকে শিক্ষিত এবং জ্ঞানী বলে ভাবেন পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ এবং উত্তর বঙ্গের বাঙালিরা। ইংরেজি-মিডিয়াম-ইস্কুলে পড়া ছেলেমেয়ে বাংলা বলতে না পারলে অভিভাবকরা খুশিতে বাগ বাগ। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বাংলা ভাষাকে পা মাড়িয়ে হিন্দি যখন এসে উপস্থিত হবে, স্বাগত জানাবেন বলে বসে আছেন। দিল্লিতে কেরালার কিছু বন্ধু আমার আছে, ওঁরা এখানে বহু বছর চাকরি বাকরি করছেন। আমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওঁরা কখনও একটি হিন্দি শব্দও ব্যবহার করেন না। ওঁরা কারও সঙ্গেই তা করেন না, একান্তই জরুরি না হলে। দিল্লিতে আমার কিছু বাঙালি পরিচিত লোক আছেন, আমি তাঁদের সঙ্গে বাংলা বলি, কিন্তু বাংলা বলতে তাঁদের আড়ষ্টতা আমি লক্ষ করি। তাঁরা হিন্দি বলতেই আরাম পান। আর দু’ক্লাস পড়াশোনা করেই, ভুল হোক ক্ষতি নেই, ইংরেজি বলতে পারলে, তাঁরাও জানেন, শিক্ষিতের কাতারে কী অনায়াসে চলে যাওয়া যায়। একটি দিনের কথা আমি কখনও ভুলবো না। সম্ভবত ২০০৬ বা ২০০৭ সালের দিকে ঘটেছিল। কলকাতা শহরের সল্টলেকে এক সিনেমায় অতিথিদের জন্য ‘অনুরণন’ নামে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছিল। তার আগে একটি আলোচনা সভার অয়োজন করা হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি বাংলায়, আলোচক সকলেই বাংলা জানেন, দর্শক সকলে বাঙালি, অথচ আলোচকদের সকলকে ইংরেজিতে আলোচনা করতে হবে। সেই অনুষ্ঠানের নিয়ম আমি ভঙ্গ করেছিলাম। সকলে ইংরেজিতে আলোচনা করলেও আমি বাংলায় করেছি। আলোচক এবং নিয়ন্ত্রক বড় অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। আমার বক্তব্য অন্যদের চেয়ে বেশি ভালো, বেশি তথ্যপূর্ণ এবং যুক্তিপূর্ণ হলেও যেহেতু আমি বাংলায় বলেছি, মুহূর্তে আমি ব্রাত্য হয়ে যাই সকলের কাছে। বাংলায় বলেছি বলে অনুষ্ঠানের বক্তাদের জন্য যে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল, সেখানে আয়োজকরা আমাকে ডাকেননি। এই ঘটনাতেই কি স্পষ্ট হয় না বাংলার শিক্ষিত শ্রেণি বাংলাকে কতটা ঘৃণা করেন এবং ইংরেজিকে কতটা ভালোবাসেন!

 

যতই ভাষা দিবস পালন হোক না কেন, যতই বছর বছর বাংলা বইয়ের মেলা হোক না কেন, বাংলা ভাষার মৃত্যু অবধারিত। ভাষাকে ভালো না বাসলে ভাষা মরে যায়। ভারতবর্ষের কোনও রাজ্যে অনায়াসে হিন্দি এসে পাকা আসন গেড়ে যদি বসতে চায়, সে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যত ব্যবধানই পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের থাকুক না কেন, ভাষাকে ধ্বংস করার ব্যাপারে দু’বাংলাই সমান উদ্যোগী। বাংলা নিয়ে দু’বাংলাতেই মানুষের প্রচণ্ড লজ্জা।

 

৩. আমাকে একটি ভাষা শিখিয়েছিল আমার মা, মায়ের নিজের ভাষা। ভাষাটি শিখতে শিখতে বড় হয়েছি, শিখতে শিখতে মানুষ। ভাষাটি ছিল বলে কথা বলেছিলাম, খিদে-তেষ্টার কথা, ইচ্ছের কথা, ইচ্ছেগুলোর কথা মুখ ফুটে বলেছিলাম, ‘আমার প্রাপ্যটুকু চাই।’ ভাষাটি ছিল বলে গান গেয়েছিলাম, প্রতিবাদ লিখেছিলাম দেওয়ালে, ব্যক্তিগত কাগজে। ব্যক্তিগত কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকেনি, আগুন হয়ে ছড়িয়েছিল সারা দেশে। ভাষাটি আমাকে দিন দিন কী আশ্চর্য রকম শক্তিময়ী করে তুলেছিল, আমি আর সেই সাত চড়ে রা না করা আমি ছিলাম না। রেললাইনের গুমটি ঘরে ঘুরে বেড়ানো, বিকেলজুড়ে গোল্লাছুটের আমি ছিলাম না। বাড়ির ছাদে বসে একা একা রাতের তারা গোনার আমি ছিলাম না। আমি তখন হাজার মানুষের ভিড়ে হাঁটছি, আমি তখন বিভেদগুলো ভাঙছি, আমি তখন অগুন্তি বিষবৃক্ষ উপড়ে তুলছি। আমি তখন কেবল আমার নয়, সহস্র কোটির প্রাপ্যের কথা চিৎকার করে বলছি। শুনে এমনই রাগ ওদের, গলা চেপে ধরেছিল আমার, ভাষা কেড়ে নেবে। হাত থেকে কলম কেড়ে নিল, ভাষা কেড়ে নেবে। বই পোড়ানোর উৎসব করল শহরে-নগরে, গঞ্জে-গ্রামে। ভাষা কেড়ে নেবে। আমাকে পোড়াল। পুড়ে আমি অঙ্গার হইনি, ইস্পাত হয়েছি। যে শক্তি আমাকে দিয়েছিল আমার মা, ওরা তা কেড়ে নেবে। কেউ কি নিতে পারে কারও ভেতর গভীর করে যদি কিছু থাকে, তা? কেউ কি পারে ওভাবে দু হাতে নখে দাঁতে ছিঁড়ে নিতে কিছু! ভালোবাসা পারে নিতে? ভাষা? ভাষা তো রক্তে থাকে, রক্ত থেকে কেউ কি ঠুকরে নিতে পারে ভাষার কণিকা? নির্বাসন দণ্ড হলো আমার। আর কেউ নয়, কোনও স্বজন নয়, বন্ধু নয়, ভাষাটি রইল কেবল সঙ্গে। একা একা আমরা দুজন। ভিনদেশে ভিনভাষীদের ভিড়ে আমরা দুজন, দুজনে নিভৃতে নিরালায় হৃদয়ে হৃদয়ে বাক্যবিনিময় করি। সারা রাত না ঘুমিয়ে করি। ভিন-ভাষার শক্ত শক্ত মুষ্টিতে আঘাত পেতে আমার ভাষাটিকে দিই না, ভিন-ভাষার লোমশ পায়ের তলে পিষ্ট হতে আমার ভাষাটিকে দিই না, নিরীহ নির্জন ভাষাটিকে আগলে রাখি, দেখে দেখে রাখি। ভালোবেসে রাখি। চোখের জলে ভাষার গায়ের ধুলোকালি ধুয়ে রাখি। মায়ের মতো রাখি, বোনের মতো, ভাইয়ের মতো রাখি। ভাষাটি রইল নির্বাসনে। ভাষাটি রইল বরফে তুষারে, অন্ধকারে। ভাষাটি রইল আমার উচ্চারণে নয়, শ্রবণে নয়, হৃদয়ে। চতুর্দিকের হই চই থেকে এক কোণে একা, আমার মতোই।

 

ভাষাটি ক্রমে ক্রমে অসুস্থ হয় তীব্র শীতে, ভাষাটি জমে যেতে থাকে ঠাণ্ডা বরফে। বাঁচাতে থাকি তাকে বুকের উত্তাপ দিয়ে দিয়ে, শত্রু শিবিরে বসে শুশ্রূষা করি তার। সে আমার আত্মীয় তখন, বন্ধু তখন। সে আমার মা। কত কত বছর চলে গেল, কত কেউ চলে গেল, আপন কত কেউ, যেতে যেতে সীমানা পেরোনো, চোখের আড়াল। কোনও দিন আর ফিরে না আসা দূরত্বে এক এক করে মানুষগুলো চলে গেল। আমিই পড়ে আছি একা, সব হারিয়ে ফুরিয়ে নিঃস্ব। সঙ্গে কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু ভাষাটি। ভাষাটি আছে বলে চলে যাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে পারি। ভাষাটি আছে বলে চারদিক খাঁ খাঁ করার, একলা লাগার দু-চারটে গদ্যপদ্য লিখতে পারি। খুব দুঃখ-কষ্টের দিনে ভাষার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে পারি। ভাষাটি আছে বলেই কেউ আছে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» মিরপুর থানার ৩ নং বিট পুলিশ নিয়ে আলোচনা সভা

» রিমান্ড শেষে কারাগারে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম

» শালিস করা নিয়ে ইউপি সদস্যেল ওপর হামলার চেষ্টার অভিযোগ অস্ত্র সহ তিনজন আটক

» শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কঠোর হতে চায় না সরকার: উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম

» চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর

» জনগণ প্রত্যাশা মতো গণমাধ্যমের সহায়তা পাচ্ছি না: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা

» ওমরা করার উত্তম সময় কোনটি

» মোবাইল ফোন চার্জ দিতে কত টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়?

» টি-টেন লিগে ফের ফিক্সিংয়ের গুঞ্জন!

» উপ-রাষ্ট্রপতি ও উপ-প্রধানমন্ত্রীসহ বিএনপির ৬২ প্রস্তাবনা

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

আমার কোনও দেশ নেই, ভাষাই আমার দেশ

তসলিমা নাসরিন: ১. পৃথিবীতে ভাষা আছে প্রায় সাত হাজারের মতো। অর্ধেকই মরে যাবে।

প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষার মৃত্যু হচ্ছে, বাংলা ভাষারও মৃত্যু হবে। ভাষাকে গায়ের জোরে টিকিয়ে রাখা যায় না। ভাষাকে ভালোবাসা দিয়ে টিকিয়ে রাখা যায়। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসার জন্য খুব বেশি বাঙালি অবশিষ্ট নেই। যে বাঙালির বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষা জানা নেই, সেই বাঙালিই বাধ্য হয়ে বাংলা ভাষাটি বলে। একে বিকৃত করার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই চলছে। অনেক বাঙালি বাধ্য হয়ে বাংলা বলে। ইংরেজি ভালো জানলে ইংরেজিটাই বলতো, হিন্দিটা, উর্দুটা, আরবিটা ভালো জানা থাকলে ওগুলোই বলতো, বাংলা বলতো না। প্রচুর বাঙালিকে আমি দেখেছি ইংরেজি কম জেনেও সাহেব সাজার জন্য ইংরেজি বলে। আরবি কম জেনেও ইসলাম-বিশেষজ্ঞ সাজার জন্য আরবি বলে। বাংলাকে ভালো আসলে কজন বাসে? ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শহরের ছেলেমেয়েরা পারতপক্ষে বাংলা বলতে চায় না। এরাই যদি দেশের ভবিষ্যৎ, তবে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ ঠিক কী, তা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারি।

 

ভাষার বিবর্তন প্রতিনিয়ত হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত উপন্যাসের ভাষার সঙ্গে ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত প্যারিচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালের ভাষার বিস্তর পার্থক্য। বিবর্তিত হয়ে বাংলা শেষ অবধি কোথায় পৌঁছোবে, জানি না। তবে বাংলা ভাষায় নানা ভাষা থেকে শব্দ এসেছে, কিছু শব্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসেছে, কিছু শব্দকে আনা হয়েছে জোর করে। জোর করে শব্দ ধরে আনলে পুলক জোটে হয়তো, আপাতত ভাষাকেও কিঞ্চিৎ মাংসল করা যায়, কিন্তু আখেরে ভাষার লাভ কী দাঁড়ায় সেটাই দেখার বিষয়। ভাষা ক্রমশ হাড্ডিসার হচ্ছে, ভাষার গায়ে রকমারি অলংকার চড়ানো হচ্ছে। বাংলার বৈজ্ঞানিক পরিভাষার হাল দেখলে চোখে জল আসে। প্রতিশব্দ কি রচিত হচ্ছে যতটা রচিত হওয়া উচিত? একসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছেন বৈজ্ঞানিক পরিভাষা। অভিযোজন (Adaptation), প্রজননতত্ত্ব, আঙ্গিক (Technique) এসব রবীন্দ্রনাথের তৈরি শব্দ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ শিক্ষার জন্য পারিভাষিকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু পারিভাষিক চর্ব্য জাতের জিনিস। দাঁত ওঠার পরে সেটা পথ্য। সেই কথা মনে করে যতদূর পারি পরিভাষা এড়িয়ে সহজ ভাষার দিকে মন দিয়েছি।’ সহজ ভাষায় লিখতে গিয়ে অনেক সহজ পরিভাষা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, যেমন লাল উজানি আলো (infrared light), বেগনি পারের আলো (ultra violet light), গ্রহিকা (asteroid), আঙ্গারিক গ্যাস (কার্বন ডাইঅক্সাইড)। তাঁর তৈরি প্রতিশব্দ প্রচলিত হয়নি। অনেক বিদেশি বৈজ্ঞানিক শব্দকে রবীন্দ্রনাথ সে কালেই বাংলায় গ্রহণ করেছেন, যেমন হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, প্রোটন, নিউট্রন, পজিটিভ, নেগেটিভ। আজকাল টেকনোলজি সম্পর্কিত ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কোনও কবি বা সাহিত্যিক তৈরি করার চেষ্টা করেন বলে মনে হয় না। প্রতিশব্দ তৈরি হলেও আমার মনে হয় না আদৌ কেউ ব্যবহার করতে চাইবে সেসব। শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলছেন দাদি নানিরা, মা মাসিরা। হাইটেক জীবন তাদের না হলেও চলে। হাইটেক জীবন যাদের, তারা একটি বাংলা বাক্য বললে বাক্যের ১০টির মধ্যে পাঁচটি শব্দই থাকে ইংরেজি। তারা পরিভাষা পছন্দ করে না।

 

বাংলা ভাষা সম্পর্কে এক লেখক খুব সুন্দর বলেছেন, “বাংলাকে আমরা কিন্তু শুধু অন্দরমহলের ভাষা করেই রাখলাম এ যাবৎ। কর্মজগতের ভাষা বা গুরুতর চর্চার ভাষা হিসেবে বাংলাকে বেছে নেওয়ার চেষ্টাই করলাম না সেভাবে। একটু ঘরোয়া কথকতা, একটু রোয়াকি আড্ডা, একটু ভালোবাসা, একটু বিতণ্ডা, একটু খুনসুটি, একটু রং-তামাশা এর বাইরে সেভাবে কোনও ভূমিকাই নিতে দিলাম না বাংলা ভাষাকে। বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে, গল্পে-গানে-বিনোদনেও বাংলাকে আমরা রেখেছি ঠিকই। কিন্তু এইটুকু ব্যবহারিক পরিসর ভাষার কাক্সিক্ষত বিকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। সে বিকাশের জন্য জীবনের গূঢ়তর এবং গুরুতর ক্ষেত্রগুলোতেও বাংলার ব্যবহার সুনিশ্চিত করা জরুরি ছিল। সে চেষ্টা আমরা করলাম না। বাংলাকে আমরা খিডকি-পুকুর বানিয়ে রাখলাম, যেখানে শুধু বাসন মাজি। বাংলাকে সেই মহাসমুদ্র হয়ে উঠতে দিলাম না, যে জলভাগে বাণিজ্য তরী ভাসিয়ে আমি বিশ্বজয় করতে পারি। বাণিজ্যের জন্য আমরা বেছে নিলাম ধার করা জলভাগকে।

 

ভাষা ক্রমবিবর্তনশীল, ভাষা ক্রমবিকাশশীল। সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, কোনও ভাষাই আজ পর্যন্ত সর্বাঙ্গীণ পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। আদান-প্রদানের ঘাত-প্রতিঘাতেই ভাষার বিকাশ হয়, ভাষার শব্দকোষ বাড়ে, ভাষা বলিষ্ঠ হয়, ভাষা প্রসার পায়। কিন্তু বাংলাকে অন্দরমহলে কুক্ষিগত করে রেখে সেই ঘাত-প্রতিঘাতটা থেকেই বঞ্চিত করলাম আমরা।’’

 

দরিদ্রের ভাষার এই-ই হাল হয়। রাজনীতিতে, শিক্ষায়, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, বাণিজ্যে বাংলা পিছিয়ে আছে বলে বাংলা ভাষার কোনও মূল্য নেই বাইরের দুনিয়ায়। একসময় মানুষ ইংরেজি ফরাসি শিখেছে ওই ভাষা ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষা ছিল বলে। পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, ওলন্দাজ ভাষা বাণিজ্যের কারণে শিখতো। দুর্বলের এবং দরিদ্রের ভাষা কেউ শিখতে চায় না। বাংলা শিখে চাকরি পাওয়া যায় না বলে বাঙালিরা বাংলা শেখে না, সেখানে বিদেশিরা কেন শিখবে বাংলা। এশিয়ার যে ভাষা শিখতে মানুষ আগ্রহ প্রকাশ করে, তা জাপানি অথবা চৈনিক।

 

আক্ষেপ করা মানে সময় নষ্ট করা। আর সব কিছুর মতো করে বাংলা ভাষাও নিজের মতো বেঁচে থাকবে। ভালোবেসে এটিকে উচ্চারণ যত করবো, ভাষা তত বেঁচে থাকবে। একে যত দূরে সরাবো, তত দূরে সরবে। সত্যি কথা বলতে কী, বাংলা ভাষাটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে বিদেশিদের বাংলা ভাষা জানার দরকার নেই, বাঙালিকেই বাংলাটা জানতে হবে। তাহলেই টিকে থাকবে। ভালোবাসলে আর সবকিছু যেমন টিকে থাকে, ভাষাও তেমনি টিকে থাকে। আর তা না হলে পরিণতি তো আমরা জানিই, মৃত্যু। মরলেও সহজে মরছে না, দীর্ঘ সময় নেবে। পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভাষা বাংলা। একুশ কোটি মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। একুশ কোটি মানুষের মুখের ভাষা খুব শিগগির কেড়ে নেওয়ার মতো বড় স্বৈরাচার এখনও তৈরি হয়নি কোথাও। তবে এটা ঠিক, পৃথিবীতে এই বাঙালিই তার ভাষাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে, আবার এই বাঙালিই তার ভাষাকে প্রাণপণে ঘৃণা করে। বাঙালিই এই ভাষাকে বাঁচিয়েছে, বাঙালিই এই ভাষাকে মারবে। বাইরের কোনও বহিরাগত আততায়ীর দরকার হবে না এ কাজে।

 

২. বাঙালি কি ভালোবাসে নিজের ভাষাকে? আমার অভিজ্ঞতা বলে, অধিকাংশ বাঙালিরই বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে কোনও গৌরব নেই। পূর্ব বাংলায় দেখি বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতির ওপর ধর্মের নামে আরবি ভাষা এবং আরবি সংস্কৃতি চাপানোর উৎসব, পশ্চিমবঙ্গে সর্বভারতীয় হওয়ার নামে বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতির ওপর হিন্দি ভাষা এবং হিন্দি সংস্কৃতি চাপানোর উৎসব। পশ্চিমবঙ্গের গরিব-বাঙালি হিন্দি ভাষা বলে জাতে ওঠেন, ধনী-বাঙালি ইংরেজি ভাষা বলে জাতে ওঠেন। বাংলা ভাষা আমার মতো বোকাসোকা বাংলা ভাষার লেখক কাম পাঠক মধ্যবিত্তরাই আবেগ, ভাষাকে ভালোবেসে যে মানুষ ইউরোপ আমেরিকা ছেড়ে এসেছে। এসে হতবুদ্ধি হয়ে যা দেখছি, তা হলো, কোনও মূর্খ অশিক্ষিত লোক ইংরেজি ভাষা ভালো বলতে পারলেই তাঁকে শিক্ষিত এবং জ্ঞানী বলে ভাবেন পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ এবং উত্তর বঙ্গের বাঙালিরা। ইংরেজি-মিডিয়াম-ইস্কুলে পড়া ছেলেমেয়ে বাংলা বলতে না পারলে অভিভাবকরা খুশিতে বাগ বাগ। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বাংলা ভাষাকে পা মাড়িয়ে হিন্দি যখন এসে উপস্থিত হবে, স্বাগত জানাবেন বলে বসে আছেন। দিল্লিতে কেরালার কিছু বন্ধু আমার আছে, ওঁরা এখানে বহু বছর চাকরি বাকরি করছেন। আমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওঁরা কখনও একটি হিন্দি শব্দও ব্যবহার করেন না। ওঁরা কারও সঙ্গেই তা করেন না, একান্তই জরুরি না হলে। দিল্লিতে আমার কিছু বাঙালি পরিচিত লোক আছেন, আমি তাঁদের সঙ্গে বাংলা বলি, কিন্তু বাংলা বলতে তাঁদের আড়ষ্টতা আমি লক্ষ করি। তাঁরা হিন্দি বলতেই আরাম পান। আর দু’ক্লাস পড়াশোনা করেই, ভুল হোক ক্ষতি নেই, ইংরেজি বলতে পারলে, তাঁরাও জানেন, শিক্ষিতের কাতারে কী অনায়াসে চলে যাওয়া যায়। একটি দিনের কথা আমি কখনও ভুলবো না। সম্ভবত ২০০৬ বা ২০০৭ সালের দিকে ঘটেছিল। কলকাতা শহরের সল্টলেকে এক সিনেমায় অতিথিদের জন্য ‘অনুরণন’ নামে একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছিল। তার আগে একটি আলোচনা সভার অয়োজন করা হয়েছিল। চলচ্চিত্রটি বাংলায়, আলোচক সকলেই বাংলা জানেন, দর্শক সকলে বাঙালি, অথচ আলোচকদের সকলকে ইংরেজিতে আলোচনা করতে হবে। সেই অনুষ্ঠানের নিয়ম আমি ভঙ্গ করেছিলাম। সকলে ইংরেজিতে আলোচনা করলেও আমি বাংলায় করেছি। আলোচক এবং নিয়ন্ত্রক বড় অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। আমার বক্তব্য অন্যদের চেয়ে বেশি ভালো, বেশি তথ্যপূর্ণ এবং যুক্তিপূর্ণ হলেও যেহেতু আমি বাংলায় বলেছি, মুহূর্তে আমি ব্রাত্য হয়ে যাই সকলের কাছে। বাংলায় বলেছি বলে অনুষ্ঠানের বক্তাদের জন্য যে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল, সেখানে আয়োজকরা আমাকে ডাকেননি। এই ঘটনাতেই কি স্পষ্ট হয় না বাংলার শিক্ষিত শ্রেণি বাংলাকে কতটা ঘৃণা করেন এবং ইংরেজিকে কতটা ভালোবাসেন!

 

যতই ভাষা দিবস পালন হোক না কেন, যতই বছর বছর বাংলা বইয়ের মেলা হোক না কেন, বাংলা ভাষার মৃত্যু অবধারিত। ভাষাকে ভালো না বাসলে ভাষা মরে যায়। ভারতবর্ষের কোনও রাজ্যে অনায়াসে হিন্দি এসে পাকা আসন গেড়ে যদি বসতে চায়, সে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যত ব্যবধানই পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের থাকুক না কেন, ভাষাকে ধ্বংস করার ব্যাপারে দু’বাংলাই সমান উদ্যোগী। বাংলা নিয়ে দু’বাংলাতেই মানুষের প্রচণ্ড লজ্জা।

 

৩. আমাকে একটি ভাষা শিখিয়েছিল আমার মা, মায়ের নিজের ভাষা। ভাষাটি শিখতে শিখতে বড় হয়েছি, শিখতে শিখতে মানুষ। ভাষাটি ছিল বলে কথা বলেছিলাম, খিদে-তেষ্টার কথা, ইচ্ছের কথা, ইচ্ছেগুলোর কথা মুখ ফুটে বলেছিলাম, ‘আমার প্রাপ্যটুকু চাই।’ ভাষাটি ছিল বলে গান গেয়েছিলাম, প্রতিবাদ লিখেছিলাম দেওয়ালে, ব্যক্তিগত কাগজে। ব্যক্তিগত কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকেনি, আগুন হয়ে ছড়িয়েছিল সারা দেশে। ভাষাটি আমাকে দিন দিন কী আশ্চর্য রকম শক্তিময়ী করে তুলেছিল, আমি আর সেই সাত চড়ে রা না করা আমি ছিলাম না। রেললাইনের গুমটি ঘরে ঘুরে বেড়ানো, বিকেলজুড়ে গোল্লাছুটের আমি ছিলাম না। বাড়ির ছাদে বসে একা একা রাতের তারা গোনার আমি ছিলাম না। আমি তখন হাজার মানুষের ভিড়ে হাঁটছি, আমি তখন বিভেদগুলো ভাঙছি, আমি তখন অগুন্তি বিষবৃক্ষ উপড়ে তুলছি। আমি তখন কেবল আমার নয়, সহস্র কোটির প্রাপ্যের কথা চিৎকার করে বলছি। শুনে এমনই রাগ ওদের, গলা চেপে ধরেছিল আমার, ভাষা কেড়ে নেবে। হাত থেকে কলম কেড়ে নিল, ভাষা কেড়ে নেবে। বই পোড়ানোর উৎসব করল শহরে-নগরে, গঞ্জে-গ্রামে। ভাষা কেড়ে নেবে। আমাকে পোড়াল। পুড়ে আমি অঙ্গার হইনি, ইস্পাত হয়েছি। যে শক্তি আমাকে দিয়েছিল আমার মা, ওরা তা কেড়ে নেবে। কেউ কি নিতে পারে কারও ভেতর গভীর করে যদি কিছু থাকে, তা? কেউ কি পারে ওভাবে দু হাতে নখে দাঁতে ছিঁড়ে নিতে কিছু! ভালোবাসা পারে নিতে? ভাষা? ভাষা তো রক্তে থাকে, রক্ত থেকে কেউ কি ঠুকরে নিতে পারে ভাষার কণিকা? নির্বাসন দণ্ড হলো আমার। আর কেউ নয়, কোনও স্বজন নয়, বন্ধু নয়, ভাষাটি রইল কেবল সঙ্গে। একা একা আমরা দুজন। ভিনদেশে ভিনভাষীদের ভিড়ে আমরা দুজন, দুজনে নিভৃতে নিরালায় হৃদয়ে হৃদয়ে বাক্যবিনিময় করি। সারা রাত না ঘুমিয়ে করি। ভিন-ভাষার শক্ত শক্ত মুষ্টিতে আঘাত পেতে আমার ভাষাটিকে দিই না, ভিন-ভাষার লোমশ পায়ের তলে পিষ্ট হতে আমার ভাষাটিকে দিই না, নিরীহ নির্জন ভাষাটিকে আগলে রাখি, দেখে দেখে রাখি। ভালোবেসে রাখি। চোখের জলে ভাষার গায়ের ধুলোকালি ধুয়ে রাখি। মায়ের মতো রাখি, বোনের মতো, ভাইয়ের মতো রাখি। ভাষাটি রইল নির্বাসনে। ভাষাটি রইল বরফে তুষারে, অন্ধকারে। ভাষাটি রইল আমার উচ্চারণে নয়, শ্রবণে নয়, হৃদয়ে। চতুর্দিকের হই চই থেকে এক কোণে একা, আমার মতোই।

 

ভাষাটি ক্রমে ক্রমে অসুস্থ হয় তীব্র শীতে, ভাষাটি জমে যেতে থাকে ঠাণ্ডা বরফে। বাঁচাতে থাকি তাকে বুকের উত্তাপ দিয়ে দিয়ে, শত্রু শিবিরে বসে শুশ্রূষা করি তার। সে আমার আত্মীয় তখন, বন্ধু তখন। সে আমার মা। কত কত বছর চলে গেল, কত কেউ চলে গেল, আপন কত কেউ, যেতে যেতে সীমানা পেরোনো, চোখের আড়াল। কোনও দিন আর ফিরে না আসা দূরত্বে এক এক করে মানুষগুলো চলে গেল। আমিই পড়ে আছি একা, সব হারিয়ে ফুরিয়ে নিঃস্ব। সঙ্গে কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু ভাষাটি। ভাষাটি আছে বলে চলে যাওয়া মানুষগুলোর সঙ্গে মনে মনে কথা বলতে পারি। ভাষাটি আছে বলে চারদিক খাঁ খাঁ করার, একলা লাগার দু-চারটে গদ্যপদ্য লিখতে পারি। খুব দুঃখ-কষ্টের দিনে ভাষার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে পারি। ভাষাটি আছে বলেই কেউ আছে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com